ষোড়শ অধ্যায়
বন্যা ও খরা
সৃষ্টির শুরুতে ঈশ্বর মানুষকে দায়িত্ব দিয়েছেন সবকিছুর উপর প্রভুত্ব করতে অর্থাৎ সবকিছুর যত্ন ও দেখাশুনা করতে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি, মানুষ তার কর্তব্য ঠিকভাবে করছে না। সৃষ্টিকে দেখাশুনা না করে সে বরং এগুলো ধ্বংস করছে। এ কারণে পৃথিবীর নানা দেশের মতো আমাদের দেশেও প্রতিবছর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে। এ দেশে প্রতিবছর বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, মহামারিসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়। এগুলোর মধ্যে বন্যা ও খরা অন্যতম।
বন্যার কারণ
ক) হঠাৎ পানির চাপ বৃদ্ধি পেয়ে নদীর দুই কূল প্লাবিত হয়ে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তাকেই বন্যা বলা হয়। অতিবৃষ্টিতে শহরের পানিও অনেক সময় নর্দমা দিয়ে সরে যেতে বিলম্ব হলে রাস্তাঘাট ডুবে যায়। সেটাও এক ধরনের বন্যা। শহরের বন্যা অনেক সময় ক্ষণস্থায়ী থাকে। তবে কোনো কোনো সময় শহরের বন্যা দীর্ঘস্থায়ীও হয়ে থাকে। যেমন, ১৯৮৮ এবং ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের বন্যা ঢাকা শহরের বেশ কয়েকটি অঞ্চল প্রায় মাসখানেক প্লাবিত করে রেখেছিল।
খ) আমাদের দেশের সমতলভূমির পাশেই ভারতের পাহাড়ি এলাকা। সেখানে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলে বৃষ্টির সব পানি বাংলাদেশের সমতল ভূমিতে চলে আসে। এর ফলে বাংলাদেশ বন্যাকবলিত হয়। আমাদের দেশেও অতিমাত্রায় বৃষ্টি হলেও বন্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
গ) দিন দিন আমাদের দেশের লোকসংখ্যা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এই অতিরিক্ত লোকের বাসস্থানের জন্য পর্যাপ্ত সমতল ভূমি না থাকায় নিম্নাঞ্চল ভরাট করা হচ্ছে। যার ফলে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
ঘ) নদীমাতৃক এ দেশে অসংখ্য নদী রয়েছে। ময়লা আবর্জনা ফেলতে ফেলতে এবং বালুর আস্তরণ জমতে জমতে অনেক নদী ভরাট হয়ে গেছে। নদী পুনর্খননের ব্যবস্থা না থাকায় এ দেশে প্রায় প্রতিবছরই বন্যা হয়।
ঙ) এ ছাড়া প্রতিবছর মৌসুমি বায়ুর প্রভাব, হিমালয়ের বরফ গলা পানি, অবৈধভাবে বনাঞ্চল উজাড় করা বা গাছ কাটা, নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বন্ধ করে বাঁধ দেওয়া, নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা, ছোট ছোট নদীনালা, খালবিল ভরাট করে বড় বড় শিল্প কলকারখানা তৈরি করার কারণে আমাদের দেশে প্রতিবছর বন্যা দেখা দিচ্ছে। চ) কলকারখানা, গাড়িঘোড়া, নানা স্থানের আগুন ইত্যাদি থেকে সৃষ্ট গ্যাসের প্রভাবে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় গ্রিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ডসহ পৃথিবীর অনেক স্থানের হাজার হাজার বছরের জমা বরফ গলে পানি হয়ে সমুদ্রে পতিত হচ্ছে। এভাবে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের অনেক স্থান পানির নিচে ডুবে যাচ্ছে।
বন্যার ফল
বন্যার ফলে নিম্নলিখিত ফলগুলো দেখা দেয়: লোকেরা কাজকর্ম করতে পারে না। অনেকের ঘরে খাবার থাকে না। অনেক ঘরবাড়ি পানির নিচে ডুবে থাকে। অতিরিক্ত ও দীর্ঘমেয়াদি বন্যায় কৃষকের ফসলাদি নষ্ট করে দেয়। গবাদি পশুপাখি মারা যায়। ব্যাপকভাবে খাদ্যের অভাব দেখা দেয়। বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দেয়। অনেক পানিবাহিত রোগ (কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয়) প্রকট আকার ধারণ করে। বেকারত্বের সংখ্যা বাড়িয়ে তোলে। প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান দ্রব্যাদি নষ্ট করে দেয়। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যায়। মৌলিক মানবিক চাহিদার (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা) ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেয়। বাসস্থান ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। মানুষের মনে ব্যাপক নিরাশা ও হতাশার সৃষ্টি করে। এমনকি অনেক মানুষের প্রাণহানিও ঘটে।
খরার কারণ
দীর্ঘকালীন শুষ্ক আবহাওয়া ও অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের কারণে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তাকে খরা বলে। নানা কারণে আমাদের দেশে খরার সৃষ্টি হয়ে থাকে। বৃষ্টিপাতের চেয়ে শুষ্ক আবহাওয়ার পরিমাণ বেশি হলে খরার সৃষ্টি হয়। নদীনালা, খালবিল ইত্যাদি শুকিয়ে গেলে
বন্যা ও খরা
পানির অভাবে খরা পরিলক্ষিত হয়। বনাঞ্চল উজাড় করা বা গাছ কাটার ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। ফলে আমাদের দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কমে যায় এবং দেশে খরা দেখা দেয় । ছোট ছোট নদীনালা, খালবিল ভরাট করে বড় বড় শিল্প কলকারখানা তৈরি করার কারণে এবং নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ার কারণে আমাদের দেশের নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে দেশে খরার সৃষ্টি হচ্ছে।
খরার ফল
খরার ফলও আমাদের দেশে খুবই ভয়াবহ আকার ধারণ করে। খরার কারণে দেশে প্রচণ্ড শুষ্ক আবহাওয়া, প্রখর সূর্যের তাপ ও গরম অনুভূত হয়। প্রচণ্ড গরমে মানুষের জীবন অতিষ্ট হয়ে ওঠে খরার কারণে মানুষের মধ্যে অনেক রোগজীবাণু বিস্তার লাভ করে। আমাদের দেশের আবাদি ও অনাবাদি জমি শুকিয়ে যায়। সেই জমিতে কোনো রস থাকে না। ফলে ফসলও ফলে না। কুয়ো, খালবিল, নদনদী শুকিয়ে যায়। পানির স্তর নিচে নেমে যায় এবং পানির অভাব দেখা দেয়। ক্ষেতের ফসল শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। মানুষ ও গবাদি পশুপাখির খাদ্যের ঘাটতি দেখা দেয়। ধূলিঝড়ের সৃষ্টি হয়। শারীরিক শ্রমে অনেক বেশি ক্লান্তি নেমে আসে ।
বন্যা ও খরায় আমাদের করণীয়
১। ঈশ্বর আমাদের যে দায়িত্ব দিয়েছেন সবকিছু দেখাশুনা ও যত্ন করার সে বিষয়ে সচেতন হওয়ার জন্য আলোচনা সভার আয়োজন করা ৷
২। সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে কীভাবে প্রকৃতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা যায় তার উপায় বের করা ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা ।
৩। বন্যা বা খরা হয় না, এমন সব এলাকার লোকজন বন্যা ও খরাকবলিত মানুষের জন্য ত্রাণ বিতরণ কাজে অংশগ্রহণ করা। অন্যদের কাছ থেকে টাকাপয়সা, খাদ্য, জামাকাপড়, চিকিৎসা ও ঘরবাড়ি মেরামতের জন্য বাঁশ ইত্যাদি সংগ্রহ করেও ত্রাণ বিতরণ কাজে অংশ— গ্রহণ করা ।
৪। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা।
৫। খরা বা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের নৈতিক সমর্থন দান করা।
কী শিখলাম
প্রকৃতিকে আমরাই যত্ন নিয়ে বাঁচাতে পারি। বন্যা ও খরার সময় আমরা মানুষকে সাহায্য করব।
অনুশীলনী
১। শূন্যস্থান পূরণ কর
(ক) নদী মাতৃক এদেশে অসংখ্য-------------------রয়েছে।
(খ) শহরের বন্যা অনেক সময়--------------------থাকে।
(গ) আমাদের দেশের--------------------পাশেই ভারতের পাহাড়ি এলাকা।
(ঘ) খরার কারণে মানুষের মধ্যে অনেক --- বিস্তার লাভ করে।
(ঙ) আমাদের দেশের আবাদি ও-----------------জমি শুকিয়ে যায়।
৩। সঠিক উত্তরটিতে টিক (√) চিহ্ন দাও
৩.১। বাংলাদেশের বন্যার কারণ কী?
(ক) অনাবৃষ্টি (খ) অতিবৃষ্টি (গ) অপর্যাপ্ত বৃষ্টি (ঘ) পর্যাপ্ত বৃষ্টি
৩.২ শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে কিসের সৃষ্টি হয় ?
(ক) বন্যা
(খ) খরা
(গ) অতিবৃষ্টি
(ঘ) অনাবৃষ্টি
৩.৩ কী কারণে আমাদের দেশে খরা সৃষ্টি হয়?
(ক) বন্যার কারণে (খ) সূর্যের তাপ (গ) পানির অভাবে (ঘ) গাছ কাটার কারণে
৩.৪ খরার কারণে আমাদের জমিতে
(ক) রস থাকে না (খ) গাছ থাকে না (গ) পানি থাকে না (ঘ) সার থাকে না
৩.৫ খরার কারণে আবহাওয়া কীরূপ অনুভূতি হয়?
(ক) শীতল
(খ) শুষ্ক
(গ) আর্দ্র
(ঘ) নাতিশীতোষ্ণ
৪। সংক্ষেপে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও
(ক) বন্যা বা খরার খবর কীভাবে মানুষকে জানাতে হয়?
(খ) বন্যার প্রস্তুতির জন্য মানুষকে কীভাবে সচেতন করতে হয়?
(গ) কীভাবে বন্যার সময় ত্রাণকাজে সাহায্য করা যায়?
৫। নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও
(ক) কীভাবে বন্যার সৃষ্টি হয়?
(খ) বন্যার ফলাফল লেখ।
আরও দেখুন...